সকলের জানা পৃথিবী নামক মানবগ্রহটি আজ বড় অন্ধকার সময় পার করছে। এ অন্ধকার রাতের গহীন কালোর চেয়েও ঢের কালো। চারদিকে বাজছে এক নিরব যুদ্ধের দামামা। যে যুদ্ধের নাম কভিট-১৯ বা করোনা মহামারি। সে যুদ্ধ কোন দেশের সাথে দেশের নয়; বরং অদৃশ্য মরণঘাতী ভাইরাসের সাথে মানবসভ্যতার। বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষ ও মানবতা। আজ মানুষ যেন মানুষের বড় শত্রু। একে অন্যের স্পর্শ যেন বিষের চেয়েও বিষাক্ত। একের স্পর্শে অন্যের কাছে যাওয়া করোনা ভাইরাসের ভয়ে মুহূর্তেই সন্তান ভুলে যাচ্ছে পিতা-মাতা আর স্বামী-স্ত্রীর স্বর্গীয় সম্পর্ক। এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি সারা দুনিয়া। করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারীর লাশ পড়ে আছে, কেউ ছুঁয়েও দেখে না। অসুস্থ বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে রাস্তার ধারে। করোনা উপসর্গ আছে বলে মাকে হাসপাতালের গেইটে ফেলে সন্তানের পালায়ন। স্ত্রীকে রেখে স্বামীর দৌড়! স্বামীর পাশে স্ত্রীর ছায়াও নেই। মানবতার আর্তনাদে আকাশ বাতাস বারি হয়ে আসছে। ঠিক তখনই টকশোর টেবিল গরম করে এক কথিত মানবিক উপস্থাপিকার জোর দাবি, করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের পুড়িয়ে ফেলা হোক!
এ অমানবিক দাবি সকলের মনে আরও বেশি ভয়ের সঞ্চার করলো। এমন ঘোষণা সকল সচেতন মানুষের পাশাপাশি একজন প্রকৃত মানবিক বন্ধুর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করলো। কী করা যায় মানবতার জন্য, কী করা যায়; ভাবতে ভাবতে চিন্তার বন্দরে নোঙর করলো এক অসাধারণ কনসেপ্ট। আর তা হলো করোনায় মৃতের দাফন-কাফন ও সৎকার কার্যক্রম। এ দুঃসাধ্য কর্মযজ্ঞের সহজ স্বপ্নদ্রষ্টা আর কেউ নন, হোসাইনী আদর্শে অনুপ্রাণিত, গাউসে পাকের সৈনিক, বরেণ্য গবেষক এডভোকেট সৈয়দ মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার। যিনি মানবতার সংগঠন গাউসিয়া কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত বাংলাদেশের সম্মানিত মুখপাত্র। এ বিদগ্ধ সংগঠকের একটি ফেইসবুক স্টাটাস (করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের দাফন-কাফন করবে গাউসিয়া কমিটি) ক্ষোভ, ভয় ও শঙ্কিত আত্মায় প্রশান্তির সূর্যোদয় ঘটায়। ঘোষণা মাত্রই কাজ শুরু। অবশ্য দরবারে সিরিকোটের দীপ্তিমান সূর্য দূরদর্শী পীর সাবির শাহ আরও এক দশক আগ থেকে গাউসিয়া কমিটির কর্মীদের দাওয়াতে খায়ের কার্যক্রমের মাধ্যমে মৃতের গোসল ও দাফন-কাফনের মতো অত্যন্ত জরুরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখার তাগাদা দিয়ে গেছেন। যা গাউসিয়া কমিটির কর্মীরা পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন করেছেন। যে প্রশিক্ষণ করোনাকালিন সকল মানুষের জন্য অন্ধের যষ্টিতে পরিনত হয়েছে।
২০২০ সালে শুরুতে করোনা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। কেউ কেউ বলছিল করোনা বাংলাদেশে আসবে না। আসলেও ভয়াবহ হবে না। কিন্তু দূরদর্শী গাউসিয়া কমিটির মানবিক টিম সেইদিন থেকে প্রস্তুত ছিল। করোনা এখন ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর। প্রথম দ্বিতীয় শেষে করোনার এখন চুড়ান্ত ঢেউ চলছে। চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। আজ পর্যন্ত এ করোয়ায় বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার তাজাপ্রাণ ঝড়ে গেছে। সংক্রামণের কোন অন্ত নেই। সারাবিশ্বে একটিই শ্লোগান! ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন এবং ঘরে থাকুন। প্রায় সকলেই যখন ঘরে তখন গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিবা-রাত্রি বাইরে। কী সকাল, কী সন্ধ্যা! বিরামহীন ছুটে চলা। সব চাকরিতে ছুটি আছে। আছে বিশ্রাম। কিন্তু এ মানবিক কাজে ঈদের দিনেও ছুটি নেই। নেই রাতেও বিশ্রাম। ছুটি কেউ দিচ্ছে না তা নয়; বরং বলা চলে এ মানবিক কর্মীরা ছুটি নিচ্ছে না! রমজানে সবাই যখন বাহারি ইফতারের পশরা সাজিয়ে বসে, ঠিক তখন গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা লাশ দাফন বা অ্যাম্বুলেন্সে রোগী বহন কিংবা অক্সিজেনের বোতল কাধে মানুষের জীবনে আলো ফেরাতে ব্যস্ত। ইফতার হিসেবে সামান্য পানিতেই স্বাদ মিটিয়েছিল তারা। রোজামুখে সবাই যখন বিশ্রামে গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা তখন লকডাউনে কর্মহীন মানুষের ঘরে ঘরে সাহরি ও ইফতার সামগ্রী নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছিল। সবাই যখন নিজের ঈদ শপিংয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন গাউসিয়া কমিটির কর্মীরা নিজের শপিংয়ের টাকায় অভুক্তের মুখে অন্নদান করে হাসি ফুটিয়েছিল। ঈদুল আযহায় যখন আমরা কুরবানি পশুর গোশতের ঝোলে পিঠা ভিজিয়ে অমৃতের স্বাদ নিয়েছিলাম, ঠিক তখন গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা মুমূর্ষুর মুখে অক্সিজেন সেবা দিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।
মানবতার পরম বন্ধু গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মানব দরদী এক মহান সংস্কারক যিনি আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মাদ তৈয়্যব শাহ নামে সমাদৃত। তিনি প্রিয় নবী (স.)’র ৪০ তম নুরানি বংশধর। তৈয়্যব শাহ এ নামটিতেই আছে প্রেমের ঝর্ণাধারা। যে প্রেমের মেলবন্ধন সুদূর বাগদাদ হয়ে ঈমানের বাড়ি মদিনা। ইসলামি দুনিয়ায় মুজাদ্দিদে জমান তৈয়্যব শাহ’র অবদান অনস্বীকার্য। ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)-কে কেন্দ্র করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুছ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মসজিদ, মাদরাসা, খানেকা প্রতিষ্ঠা, কিতাব রচনায় উনি একজন বহুমাত্রিক পীর। ১৯৮৬ সালে এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সংস্কারক তৈয়্যব শাহ’র হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আজকের মানবিক গাউসিয়া কমিটি। অবশ্য এ মাদানি কাফেলার গোড়াপত্তন আরও বহুদিন আগে। দূর আরবে মরুর দুলাল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুলের ছায়াসংগঠন গাউসিয়া কমিটি। ফিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা করেন প্রিয় রাসূল (স.) আর গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন আউলাদে রাসূল (স.)। তাই উভয় সংগঠনের কার্যক্রমে আছে সুনিপুণ মিল। আরবের বিখ্যাত ওকাজ মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে কুরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে সকলের মাঝে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিশ্চিত এবং সামাজিক ঐক্য, মানুষের সেবা, অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে সমমনা যুবকদের নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স.) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিলফুল ফুজুল। যে সংগঠন অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব সমাজে জ্যোতি ছড়িয়েছে। গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এযাবৎ কল্যাণমূলক কাজগুলো নিয়ে গবেষণা করলে যেকোনো বিদগ্ধজনের কাছে এ সংগঠন নিঃসন্দেহে হিলফুল ফুজুলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন মনে হবেই। তরিকত জগতের আফতাব গাউসিয়া কমিটি এখন মানবতার আকাশে ধ্রুবতারা।
এ সেবা কি শুধু মুসলমানদের জন্য? নারে ভাই, না। এ সেবা সব মানুষের জন্য। হোক না সে লাওয়ারিশ, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। সকলের তরে গাউসিয়া কমিটির এহসান। গাউসিয়া কমিটির মানবসেবা বিধর্মীদের কাছেও শান্তির বার্তা দেয়। দিন-রাত বিনিময়হীন কর্মে ছুটে চলা। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদল, আগুন-পানি কোন প্রতিবন্ধকতা তাঁদের এ অদম্য ছুটে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। যে করোনা রোগী ভয়ের কারণ, সে করোনা রোগীর সেবায় ব্যস্ত গাউসিয়া কমিটি। স্বজনের ফেলে দেওয়া ভালোবাসাগুলোকে খুড়িয়ে কাধে তুলে শেষ বিদায়ে উপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছে গাউসিয়া কমিটি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, গাউসিয়া কমিটি মুসলমানদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। হে আল্লাহ এ মানবিক মানুষগুলোকে নিরাপদে রাখুন। উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। হাজার সালাম হে গাউসিয়া কমিটি।
এ কাজে গাউসিয়া কমিটির চারটি অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি রয়েছে প্রায় তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবক। যে ফোন করছে রোগী বহনের জন্য। অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলছে সেদিকে। একটু নিঃশ্বাসের জন্য চারিদিকে হাহাকার। একটু অক্সিজেন হলে বেঁচে যায় তাজাপ্রাণ। বাঁচার শেষ অবলম্বন অক্সিজেন নিয়ে হাজির গাউসিয়া কমিটি। গভীর রাতেও রোগীর স্বজনের ফোনে বিরক্ত হন না মানবিক টিমের কেন্দ্রীয় সদস্য মাওলানা আব্দুল্লাহ, মাওলানা এরশাদ খতিবী ও আহসান হাবিব চৌধুরী হাসান। প্রতিদিন ২০ জন মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন-কাফনের কাজ করতে হয় তাঁদের। শুধু মুসলিম নয় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সৎকারও করছে অতি সম্মানের সাথে। এ মানবিক সংগঠনের চেয়ারম্যান পেয়ার মোহাম্মদ কমিশনার ও মহাসচিব শাহজাদ ইবনে দিদারের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, সর্বশেষ ২৮ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রামে ২ হাজার ৯৮৪ জনসহ সারাদেশে ৩ হাজার ৬৫৬ জন মৃত ব্যক্তির দাফন ও সৎকার সম্পন্ন করেছে গাউসিয়া কমিটি। এদের মধ্যে ৩৭ জন হিন্দু, ৫ জন বৌদ্ধ, ১ জন মারমা, ১ জন খ্রিস্টানসহ মোট ৪৪ জন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীও আছে। এছাড়া ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধা, ২৪ জন অজ্ঞাত লাশ এবং ৪ জন কারাবন্দি কয়েদির লাশ দাফন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জীবন্ত সংজ্ঞা উপস্থাপন করেন মানবিক গাউসিয়া কমিটি। এ পর্যন্ত ২১ হাজার ২৬৩ জন করোনা রোগীকে জরুরি অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ১৪ জনকে। প্রায় ১২০০০ জনকে দেওয়া হয়েছে ফ্রি চিকিৎসা সেবা। প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন ব্যক্তিকে ভ্রাম্যমাণ কোভিড-১৯ টেস্ট টিমের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অন্ধের যষ্টি গাউসিয়া কমিটি এ করোনাকালে প্রায় আড়াই লাখ পরিবারকে দিয়েছেন খাদ্য ও অর্থ সহায়তা। সারাদেশে রোপণ করেছে লাখ লাখ গাছের চারা। এছাড়াও সারাবিশ্বে বিস্তৃত গাউসিয়ার গর্বিত কর্মীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অগণিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও আজ গাউসিয়া কমিটির সামনে শ্রদ্ধাবনত। মানবিক পীর তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র গাউসিয়া কমিটির আলো আজ গীর্জা, মন্দির ও প্যাগোডাকেও আলোকিত করছে। যে আলো সব কালো দূর করে পরিস্কার বার্তা দিচ্ছে ইসলাম শান্তির ধর্ম। জঙ্গি সন্ত্রাসীদের সাথে ইসলামের দূরতমও সম্পর্ক নেই। আসুন! আমরা নবীজির সাংগঠনিক সুন্নাতকে লালন করি। প্রিয় নবীর হিলফুল ফুজুলের অনুপ্রেরণায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের কল্যাণে নিজের মেধা-শ্রম ব্যয় করি। তবেই ইসলাম স্বমহিমায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তবেই বুক চেতিয়ে বলা যাবে আমরাই শ্রেষ্ঠ নবীর গর্বিত উম্মত।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক মাওলানা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী,প্রতিষ্ঠাতা: আলো একাডেমি, চট্টগ্রাম।