দেশের প্রথমবারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে যাচ্ছে ট্রেন। চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া হয়ে রেলপথ যাবে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাইয়ে। এর মাধ্যমে পাহাড়, লেক ও কর্ণফুলী নদীর সৌন্দর্য ঘেরা কাপ্তাই যেতে পর্যটকদের আগ্রহ ব্যাপক হারে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে চলতি অর্থবছরের কাজ শুরু করে ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। তবে প্রকল্পের অর্থায়ন জটিলতা এখনও না কাটায় এতে বাস্তবায়ন কাজ আরও পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের চন্দগাঁওয়ে জানালীহাট থেকে চুয়েট (চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) হয়ে কাপ্তাই পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে রেলওয়ে। ৪২ কিলোমিটারের ডুয়েলগেজ রেল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা ৮ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণে ব্যয় হবে ১০৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৭১৪১ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহের প্রস্তাব করেছে রেলওয়ে।
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, এ পথে রেললাইন নির্মাণ হলে চট্টগ্রাম শহরের ওপর চাপ কমবে। কারণ অনেকে রাউজান,রাঙ্গুনিয়া, কাপ্তাই থেকে প্রতিদিন আসা যাওয়া করে চট্টগ্রাম শহরে কাজ করে যেতে পারবে। এতে চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রেলওয়ের মহাপরিকল্পনায় (২০১৬-২০৪৫) কাপ্তাই পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। তবে ওই মহপরিকল্পনায় ২০২২ সালের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল। প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালে। ডাবল গেজ রেল লাইনের একটি নকশাও প্রণয়ন করা হয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ‘কাপ্তাইতে রেল সংযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পাবর্ত্য অঞ্চলের টুরিজম সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় বিশাল এই সম্পদ সেভাবে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারেনি। কাপ্তাইতে রেল সংযোগ সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের বনজ সম্পদের বাজার বৃদ্ধি পাবে। এই অঞ্চলের পণ্যস্মূহ সারা দেশের বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত জুনে প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ করতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) চিঠি দিয়েছে রেলওয়ে। সে প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (জাইকা), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ (এআইআইবি) বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইআরডি। তবে এখনও পর্যন্ত কারো কাছে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
তবে চীনের অর্থায়ন ফেরতের সুযোগ কাজে লাগাতে চায় ভারত। এ লক্ষ্যে ভারত তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটিডের মাধ্যমে কাজ পাওয়া সাপেক্ষে অর্থায়ন নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি রেলমন্ত্রী মো. রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনকে লেখা এক চিঠিতে এ প্রস্তাব দেয়।
এ বিষয়ে ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ইরকন রেলপথ মন্ত্রণালয়ে এ প্রস্তাব দিলেও তা ভারতীয় দূতাবাসারে মাধ্যমে ইআরডিতে আসতে হবে। অথবা ইরকনের প্রস্তাবের বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে ইআরডি জানাতে হবে। তারপরই কেবল ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে ইআরডি।
রেলওয়ের কর্মকর্তরা জানান, ভারতীয় অর্থায়নে কাপ্তাই পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে এখনও আগ্রহী নয় রেলওয়ে। কারণ ভারতীয় ঋণে নানা ধরনের শর্ত এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে জটিলতা থাকে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক, এডিবি আর এআইআইবির মতো সংস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, ‘ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকনের প্রস্তাবের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ইআরডির ঋণ সংগ্রহে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কারো কাছ থেকে অর্থায়নের বিষয়ে এখনও সম্মতি পাওয়া যায়নি। বিশাল ব্যয়ের এ প্রকল্পে সরকারি তহবলে থেকে এত টাকা যোগান দেওয়া কঠিন হবে।’
এদিকে রেলওয়ে জানায়, অর্থায়ন জটিলতায় এড়াতে প্রয়োজনে দুটি পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ভাবা হচ্ছে। প্রথমটি চট্টগ্রামের জালানীহাট থেকে চুয়েট এবং পবর্তীতে চুয়েট থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত। প্রথম পর্যায়ের কাজ বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৪ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।
প্রথম পর্যায়ে জানালীহাট থেকে চুয়েট পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের ৫৫ শতাংশ ব্যয় হবে ভূমি অধিগ্রহণে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে (চুয়েট-কাপ্তাই) পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবনা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহর ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এর সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পর্যটন কেন্দ্র কাপ্তাই পর্যন্ত সহজে এবং মসৃণ পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
পরিবহন ব্যবস্থার একটি নতুন লাইন খোলার পাশাপাশি যাতে শহর এলাকায় প্রতিদিনের জনসমাগম হ্রাস পায়।
এছাড়াও, দৈনিক যানজট কমিয়ে চট্টগ্রাম শহরে বসবাসের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে নতুন যোগাযোগ পথটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বাস্তবায়িত হলে রাঙ্গামাটি জেলায় পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের চাহিদা কতখানি বাড়বে তা নিরূপণের পর প্রকল্পের নামও ঠিক করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে- ‘দোহাজারী- কক্সবাজার ভায়া রামু এবং মিয়ানমার সীমান্তের কাছে রামু-ঘুমধুম সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ।’
এছাড়াও, প্রস্তাবিত রেলপথটি ডুয়েল গেজ রেললাইন এবং আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত বর্তমান রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরের অন্যান্য প্রস্তাবিত প্রকল্পের সুবিধা বাড়াবে।
সূত্র : দ্য বিজনেজ স্ট্যার্ন্ডাড