নতুন বছরের পূর্ণ প্রভাত দিচ্ছে উঁকি। নতুন বছর মানেই নতুন এক দিগন্তের ধার উন্মোচন। বিগত বছরের অর্জনের তৃপ্তি ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। নতুন বছরের সূর্য উদয়ের সাথে সাথে সূচনা হয় নতুনভাবে পথ চলার প্রত্যয়। অমিত সম্ভবনা ও আশার আলো নিয়ে শুরু হয় নতুন এক সূর্যদয়। সামগ্রিকভাবে বিগত ২০২২ বছরটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই বছরটিতে শিক্ষার হার, জন্মহার,শিশু মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ, মাথাপিছু আয়, মানুষের গড় আয়ুর ক্ষেত্রে ছিল উল্লেখযোগ্য। বিগত এই বছরটি প্রাপ্তি ও খোয়ার মধ্যেও ছিল বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জনজীবনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি স্বরণকালের শ্রেষ্ঠ বছর, আবার কারো কারো কাছে প্রিয়জন ও শেষ সম্বল হারানোর এক নির্মম স্মৃতি বিজড়িত এ বছর।
২০২২ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা সমূহের মধ্যে ছিল আদমশুমারি গণনা। করোনার প্রকোপে দীর্ঘ সময়ের জন্য জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। এমতাবস্তায় করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ২০২১ এর পূর্ব নির্ধারিত জনশুমারির পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়। যে কারণে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ২০২২ সালের ১৫ জুন শুরু হয় দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা। ১৫ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত চলমান ৭ দিনব্যাপী গণনা পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশের বতর্মান জনসংখ্যা ১৬,৫১,৫৮,৬১৬ জন। ২৫ জুন ২০২২ দিনটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। দুই যুগ আগে পরিকল্পিত বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক তৃতীয়াংশের জেলা রাজধানী ঢাকা এবং বাকি অংশের সাথে সড়ক পথে যুক্ত হয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য একটি মাইলফলক রচিত করেছে এবং বিশ্ব দরবারে উম্মোচিত হয় বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতার উজ্জ্বল দিগন্ত। এক দশক অপেক্ষার পর ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উদ্বোধন হয় মেট্রোরেল। এটি ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পৌছাবে। মুজিব কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে মেট্রোরেলের যুগে পদার্পণ করে বাংলাদেশ। তুলনামুলক গরীব রাষ্ট্র হয়েও বড়দের পাশাপাশি ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদেরও করোনা টিকা নিশ্চিত করেছে।
বাইশের প্রাপ্তির খাতা দীর্ঘ হলেও কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা রেখাপাত করে গেছে জনজীবনে। অনাকাঙ্ক্ষিত সেসব ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের কন্টেইনার ডিপোতে আগুন। ৪ জুন, ২০২২-দিবাগত রাতে এই ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪১জন নিহত এবং ৪৫০ জন আহত হয়। অনেক পরিবার এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে হয়েছে নিঃস্ব। পিতামাতা হারিয়েছে সন্তান, স্ত্রী হারিয়েছে তার স্বামীকে, সন্তান হারিয়েছেন পিতাকে। এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ২০২২ সালকে স্বরণীয় করে রাখবে ইতিহাসের কালো পাতায়। পরপরই সিলেটের বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের মে মাসে সিলেটের নিম্নাঞ্চলে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যা শুরু হয়। সুনামগঞ্জসহ ৬ টি উপজেলায় এই বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এতে অর্ধশতাধিক নিহত, অগণিত নিখোঁজ হয়। প্রায় ১২ কোটি টাকার প্রাণিসম্পদের ক্ষতি হয় এবং বিপর্যস্ত হয় ১৩ লাখ মানুষ। এই ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দী হয় ৩০ লাখ মানুষ এবং ৪০ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যায়। এই বন্যার ভয়াবহতা কস্নিনকালেও ভুলবেনা বাঙালি জাতি।
অর্জন ও বিয়োগের এই ধারাবাহিক কালক্রমের মধ্যে আরেকটি আবেগময় সময় ছিল ২০২২ সালের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা ‘ফিফা বিশ্বকাপ’। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত হলেও এই বিশ্বকাপ বেশ উন্মাদনার মাধ্যমে উপভোগ করা হয় বাংলাদেশে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একযোগে ফুটবল বিশ্বকাপ উপভোগ করে। আর এভাবে নানা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ঘটন-অঘটন, চড়াই-উৎড়াই, আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে বাইশের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং কালের গর্ভে হারিয়ে যায় আরও একটি বছর।
পুরাতন বছরের বিদায়ের সাথে সাথে নতুন বছর হাতছানি দেয়। নতুনকে বরণ করে নেয়া মানুষের সহজাত প্রবণতা। নতুন বছরে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পাশাপাশি মানুষ ব্যাক্তিগত চরিত্র পরিবর্তনের আঙ্গীকার করে। অতীতের যাবতীয় গ্লানি ও হতাশা মুছে নতুন বছরে ভালো কিছু করার উদ্দীপনা দিয়ে কাজে মনোযোগী হয়। অসীম সমস্যার দেশে সমীম সম্পদের যথাযথ পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ব মন্দা প্রভাব কাটিয়ে নতুন বছর -২০২৩ হোক অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ একটি বছর । এই নতুন বছরটি রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও বিরোধী দলের সকল সংকীর্ণতা পরিহার করে পরস্পরের সহাবস্থানে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পরিবেশ তৈরির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা নতুন বছরের অন্যতম প্রত্যাশা। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, মান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে এগিয়ে যাক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ। নতুন বছরটি সকলের জীবনে নিয়ে আসুন শান্তি, সমৃদ্ধি ও অনাবিল আনন্দ । এই আশা ব্যক্ত করে সকলকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
লেখক
নাম : সাবিনা চৌধুরী
শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
ইমেইল :[email protected]
মোবাইল :016108961405