আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে কর্ণফুলী নদী ও শিলক ছোট নদীর তীরে।
সরফ ভাটা গ্রামে জন্মেছিলাম বলে আজ নিজকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। গত ২৫ বছরের ইতিহাসের অনুসন্ধানে অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের পর নিজ গ্রামের নামে একজন বিদেশি পর্যটক ২শত বছর আগে মূল্যবান ডায়েরি লিখে গেছেন। অগোচরে ইতিহাস উম্মোচন করা যেন ধূসর অতীত নিয়ে দুইশত বছরের এক গঞ্জ শহর আমার কাছে গুরুত্ব বেশি এবং ঐতিহাসিক একটা মূল্য আছে। সেই রাজাগঞ্জ মানে পূর্ব সরফভাটা কাজির খিল হতে কানুরহাটে ধান চালের সরিষা, তুলা, ফলমূলাদির গদিঘর ছিল।গড়ে উঠে এক ছোট নৌ বন্দর।বুকানন সেই নৌ বন্দরকে রাজাগঞ্জ হিসাবে বর্ণনামতে সরফভাটা ইউনিয়ন আদি কানুরহাট বুঝিয়েছেন। রাজাগঞ্জ বাজারটি অবশ্যই চাকমা রাজ টব্বর খাঁ চালু করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়।
ডাক্তার ফ্রান্সিস বুকানন উপনিবেশিক আমলের সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে একজন চিন্তাকর্ষক গবেষক পর্যটক ছিলেন।তিনি স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। তাঁর পাণ্ডুলিপি বর্তমানে লন্ডনে মহাফেজখানাতে রক্ষিত আছে।
এডিন বরায় চিকিৎসকশাস্ত্রে অধ্যয়নের পূর্বে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।১৮২৯ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ডাচ নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক ভেলাম ভান সেন্দেল, ফ্রান্সিস বুকাননের মূল পান্ডুলিপি সম্পাদনা করেন।
ফ্রান্সিস এর মৃত্যুর দুইশত বছর পর আমার সসরফভাটা ইউনিয়নের যে রাজাগঞ্জ নামে বাজার ব্যবস্থা ছিল তার ভ্রমণ কাহিনীতে স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। ভেলাম ভান সেন্দেল অমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। আমি সেন্দেলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
২৬.০৪.১৭৯৮ সাল
ডা: ফ্রান্সিস বুকানন
আমি চট্টগ্রামে অবস্থান করি এবং কর্ণফুলী নদীর উজানে একটি ভ্রমনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
সকালবেলাতেই আমি পাতঘাটা (পাথরঘাটা) থেকে নৌকায় চড়ি এবং সাতটার দিকে স্রোতের অনুকূলে যাত্রা শুরু করি।
দশটার দিকে প্রথম ছোট পাহাড় শুরু হলো দক্ষিণের দিকে, এর নাম করিল্লিয়া (কুরুইল্লা মুড়া সরফভাটা চিড়িঙ্গা খাল)।এটি দুটি বেশ খাড়া দাড় তৈরি করে নদীর দক্ষিণ পাড়ের খুব কাছাকাছি এসে নেমেছে। এই দুইটার এর মধ্য দিয়ে খুব চমৎকার প্রতিধ্বনি হয়। আমি এ পর্যন্ত যত রকমের প্রতিধ্বনি শুনেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম।(এখনো ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি হয়।)
উত্তর দিকে প্রকৃত জায়গাটি থেকে অল্প দূরত্বে একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়। এখান থেকে উজানের দুইধারে আবার খুব চমৎকার চাষাবাদ হওয়া সমতল ভূমি।
(পশ্চিমে বেতাগি পূর্বে সরফভাটা মিরেরখিল ও মৌলানা গ্রামকে বুঝানো হয়েছে।)নদী এখানে প্রায় ২০০ গজ ছওড়া।
সাড়ে ১১ টায় আমি উত্তর দিকে পানির দ্বারে কিছু ছোট ছোট পাহাড় পেলাম। অনেক জায়গায় নরম স্তুপিকৃত পাথরের ঘনিভূত হয়েছে। (কাঙালি শাহ ও বাচা শাহ এর মাজার সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর পাথর বিশেষ।
এর উজানে দুই ধারে সমতল। (পশ্চিম সরফভাটা ও কর্ণফুলী জুটমিল এলাকা বা ভূমিরখিল)
দুপুরের দিকে আমরা কর্ণফুলী নদীর দক্ষিন (কারর্ণফুলী লিখেছেন)পাড়ে একটি বাজারের কাছে এসে পৌঁছাই।
জায়গার নাম রাজাগঞ্জ। (পূর্ব সরফভাটা কানুরহাট ও কাজিরখিল ধান চালের গদিঘর)
এটি একটি চত্বেরের মতন। চারিদিকে বাড়িঘরসহ বেশ কিছু দোকান। এর অল্প উত্তরে ইছামতি নামের একটি ছড়া প্রবেশ করেছে। উল্টো দিক থেকে।
এই ছড়াটি এতই সরু যেখানে ডিঙ্গি প্রবেশ করতে পারে না।
এখান থেকে ছয় ঘন্টার উজানে তব্বর খাঁর বাড়ি, চাকমা জাতির প্রধান।
এটি অবশ্যই অস্থায়ী বাসস্থান (ইছামির মুখে ঘাটচেক রাজার চেকপোস্ট)
প্রধান আসেন রাঙ্গুনিয়ার আশেপাশে এলাকার রাজস্ব আদায় করতে।এইসব এলাকা তারও অধীন।
রাজাগঞ্জের দক্ষিণে কয়েকটি উঁচু পাহাড়ে অনেক জুম আছে। (সরফভাটার দক্ষিণে খাড়া পাহাড়গুলো)
এখান থেকে একটি ছোট নদী বয়ে গেছে এর নাম শিলক।
এই নদীর দু তীরে এর সমতল জমি বাঙালীদের দখলে এবং রাঙ্গুনিয়ার একাংশে পড়েছে।
মাঝি চট্টগ্রামে চাল তুলে নিতে ভুলে যাওয়ার রাজগন্জ থেকে জোগার করার চেষ্টা করলাম। যদিও এখানে রাতে অবস্থান করা হলো এবং আমাকে জানানো হলো দোকানে প্রচুর পরিমাণের চাল আছে।
তদুপরি খুব বেশি সফল হতে পারলাম না। সারারাত থেকে (সরফভাটা) রাজাগঞ্জ থেকে চাল কিনতে পারেননি বুকানন।(ভয়ে তারা চাল লুকিয়ে পেলেন।
মনে করেছেন সরকারি লোক বাজার লুন্ঠন করবে।)
২৭ তারিখ সকালে,,,, ফ্রান্সিস বুকানন
ইছামতির মুখের কাছে ফকিরহাট নামের বাজারে (শিলক ফকিরাঘাট) আমার লোকদের চাল সংগ্রহ করতে পাঠালাম।
ডাক্তার ফ্রান্সিস সবটুকু পথের দূরত্ব যোগ করে মনে হল যে আমি আসলে মাত্র ৩১ মাইল দূরত্বে অতিক্রম করেছি। এগুলো ঠিক পাশেই নদীর উত্তর পাড়ে আগে একটি বাজার ছিল (রওজার হাট)
সম্ভব ফকিরাঘাট ও রাজাগঞ্জ বাজার স্থাপনের পর এদিকটা শূন্য রয়ে পড়েছে। (কোদালা গ্রামের সবুজ সমতলের কথা বলেছেন)
ফ্রান্সিস বুকানন রাম ও সিতা পাহাড় পরিভ্রমন করে রাঙ্গামাটি হয়ে রাঙ্গুনিয়া রাজানগর চাকমারাজ বাড়িতে গমন করেছিলেন।
অর্থাৎ ফ্রান্সিস বুকানন বেতাগি গ্রামের পূর্বে সরফ ভাটার কুরুইল্ল্যা মুড়া হতে সরফভাটা কানুরহাট( রাজাগঞ্জ) শিলক ফকিরাঘাট পর্যন্ত তার ডাইরিতে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন।
চলবে,,,
২৬.০৪.১৭৯৮ সালে স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা ডা:ফ্রান্সিস বুকাননের ডায়রি থেকে।)