বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুকাল পর ১৯৮০ সনে যখন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সােনালী অধ্যায় সূচিত হতে যাচ্ছিল ঠিক ঐ সময়ে দেশে সুন্নিদের সংখ্যা যথেষ্ট ছিল কিন্তু আজকের মতো সাংগঠনিক দিক থেকে সুন্নি পন্থী মোটেই সংগঠিত ছিল না। আরাে সােজা করে বলা যায়- সুন্নিরা ছিল অরক্ষিত, বাতিলদের দাপটের মুখে অসহায়। কোন প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে ওঠে তা আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানে না। সুন্নিদের দেশজুড়ে আজ যে সাংগঠনিক বলয়, ওয়াজ মাহফিলকেন্দ্রিক অবাধে সুন্নিয়ত প্রচারের যে সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে তিন দশক আগে অর্থাৎ ১৯৮০ সনের আগে আজকের মতো পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ভাবে সুন্নিয়ত প্রচার এর কথা চিন্তা করা যেত না। তখন সুন্নি আলেমদের মাহফিল – মুনাজাতের মাধ্যমে সুন্নি জনতা কে উজ্জীবিত রেখেছিলেন। ওহাবী জামায়াত- তাবলিগিদের দেশব্যাপী সুদঢ় পদচারণা- প্রভাবের কারণে সুন্নি আলেমরা চট্টগ্রামের বাইরে বাধাহীনভাবে মাহফিল করার সাহস ও সুযোগই পাবে না। বাতিলদের বাধা ও হামলায় এমনকি চট্টগ্রামেও বহু জায়গায় সনিদের মাহফিল পণ্ড হয়েছে। চট্টগ্রামকে আমরা সুন্নিদের দুর্গ বাল। অথচ এই দুর্গেও ১৯৮০ সনের আগে সুন্নি উলামা মাশায়েখরা বহু মাহফিলে বাতিলদের। হাতে আক্রান্ত হয়েছেন। জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক দাপট, ওহাবী কওমীদের মাদ্রাসা কেন্দ্রিক প্রভাব বলয় এবং তাবলীগ জামাতের মসজিদে মসজিদে চিল্লা নামে ওহাবি মতবাদ প্রচারের প্রবল প্রতাপের সময় অরক্ষিত অসংগঠিত অসহায় গ্রস্ত সুন্নিদের জাগিয়ে তুলতে কিছু উদ্যমী তরুণ শিক্ষার্থীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা। ছাত্রসেনার কর্মীদের সূচিত সুন্নিয়তের আন্দোলন আজ সুন্নিয়তের জাগরণে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠার পর সুন্নি দাবিদারদের পক্ষ থেকে অনেক বাধা বিপত্তি এসেছে বার বার। বহু ভুইফোড় ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ছাত্রসেনার মােকাবিলায় । তখন থেকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার অস্তিত্বকে যারা মেনে নিতে পারেনি বরং পদে পদে কাঁটা বিছিয়ে তার আজও সমানভাবে সক্রিয়। সুন্নি পরিচয় ধারীদের কপটতা- বিদ্বেষী তৎপরতা এখনো থামেনি। কিন্তু এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, যতই বাধা এসেছে, ছাত্রসেনা ততই চাঙ্গা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু নয়, শতাব্দির স্মরণকালের ইতিহাসে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার মতাে সাংগঠনিক কাঠামাে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্থির করে সুন্নিয়তের প্রচারে কোনাে বলিষ্ঠ সংস্থা সংগঠনের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই না। আজ তরিকতকেন্দ্রিক, দরবার ও খানকাহকেন্দ্রিক এবং বিভিন্ন সুন্নি উলামা-মাশায়েখের উদ্যোগে অংশগ্রহণে বহু সুন্নিভিত্তিক সংস্থা-সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অথচ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আজকের মতাে সুন্নিভিত্তিক তেমন সংস্থা-সংগঠন ছিল না। ১৯৮০ সনের ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার মাধ্যমে সুন্নিয়তের সাংগঠনিক বলয় সৃষ্টির পর থেকেই সারা দেশে সুন্নিরা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বাতিলদের হিংস্রতা ও দাপটের কবল থেকে সুন্নিরা আত্মরক্ষার পথ খুঁজে পায়। কোন পর্যায়ে কোন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার পেছনের কিছু ইতিহাস আমি এখানে তুলে ধরা জরুরি মনে করি।
১৯৭৮-৭৯ সনে আমি তখন চট্টগ্রাম সােবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে জোরে শোরে চলছে, জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর তাফসিরুল কুরআন মাহফিল। কলেজিয়েট স্কুল, মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠে এবং রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া ও পতেঙ্গা স্টিল মিল বাজারে নিয়মিতভাবে সাঈদী কথিত তাফসীর মাহফিলে আসেন। সাঈদীর বিকৃত মনগড়া তাফসীর চর্চা ও কুরআন সুন্নাহর ব্যাখ্যার মাধ্যমে সহজ সরল মুসলমানদের পথভ্রষ্ট করার দৃশ্য দেখে সুন্নিদের অনেকেই তখন ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। কীভাবে সাঈদীর কথিত তফসীর মাহফিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ- প্রতিরােধ গড়া যায় এই চিন্তা সবার মাথায়। অন্যদিকে ওহাবী মৌলভীরা সুন্নিয়তের বিরুদ্ধে মাঠে- মাদ্রাসা- মসজিদে সক্রিয়। এদেরও মােকাবিলা করতে হবে। কিন্তু কি উপায়ে কার্যকরভাবে বাতিলদের অপতৎপরতা মোকাবিলা করতে হবে কারাে পক্ষ থেকে কোনাে সঠিক সিদ্ধান্ত আসছে না দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। সােবহানিয়া। আলিয়া মাদ্রাসার তখনকার প্রিন্সিপাল ছিলেন পীরে তরিকত আল্লামা সৈয়দ শামসুল হুদা (রহ)। তিনি, মুহাদ্দিস মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুস, মাওলানা আলাউদ্দিন শাহ, মাওলানা আইয়ুব আলী আজমী প্রমুখ উলামায়ে কেরাম সুন্নি আক্বীদায়, আমলে অনন্য ছিলেন। এবং খুলুসিয়াতের সাথে ছাত্রদের ইলমে দ্বীন শিক্ষা দানের পাশাপাশি তাঁরা আক্বীদার তালিম দিতেন। বাতিলদের বিশেষত চট্টগ্রামে জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক ভিত্তি দেখে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ছোবহানিয়া ছাত্রদের সুন্নীয়তের পক্ষে উজ্জীবিত দেখতে চাইতেন শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকরা। তাদের অনুপ্রেরণা- উৎসাহে বাকলিয়া আহমদিয়া করিমিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব সোনা মিয়া সওদাগরের ছেলে মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে আহ্বায়ক করে আমরা সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় তালাবায়ে আহলে সুন্নাত নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। ১৯৭৮ সনের দিকে সােবহানিয়া আলিয়ার ছাত্রদের উদ্যোগে গঠিত মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এ ছাত্র সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম আমি, মাওলানা কাজী মুঈনুদ্দিন আশরাফী, অধ্যক্ষ মাওলানা ইয়াকুব আলী খান, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী, স উ ম আব্দুস সামাদ, আলিউল ইসলাম, মাওলানা সোলাইমান সিদ্দিকী, মাওলানা আবুল হোসেন(বর্তমানে সৌদি আরবে আছেন) ও মুহাম্মদ হুমায়ুন (আমেরিকায় আছেন), মুহাম্মদ ইলিয়াস বর্তমান ব্যবসায়ী বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা], মঞ্জুরুল হক চৌধুরী (ব্যবসায়ী, নজরুল ইসলাম (ব্যবসায়ী], আবু তাহের মুজাহেদী (চাকতাইয়ের ব্যবসায়ী, আইয়ুব আলী বর্তমানে অন্য একটি দলের কর্মী], মুহাম্মদ শোয়ায়েব, (পুকুরিয়া বাঁশখালী,মধ্যপ্রাচ্যে আছেন, হাফেজ ইমরান [রাঙ্গামাটি), নাজমুল হক (বর্তমানে ব্যবসায়ী, বাড়ি-আনোয়ারা], মুহাম্মদ নূরুল আবছার, (বর্তমানে বেঁচে নেই, বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া], মুহাম্মদ আব্দুল মন্নান (বটতলী, আনোয়ারা, ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন], এবং আরো কয়েকজন ছিলেন। আমাদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করতেন সোবহানিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের পক্ষে আলহাজ্ব ইসলাম মিয়া টিকে। তিনি শুধু উৎসাহ দিতেন তা নয়, তাঁর নিজস্ব ট্রাক দিয়ে রাঙ্গুনীয়া। আলম শাহ পাড়া মাদ্রাসা মাঠে সাঈদীর তাফসির মাহফিল প্রতিরোধ করার জন্য সােবহানিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে পাঠিয়েছিলেন ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে। আমরা কয়েকজন সিনিয়র ছাত্র। রাঙ্গুনিয়ায় সাঈদীর তাফসির মাহফিল প্রতিবাদ জানাতে সেদিন ইসলাম মিয়ার ট্রেনযোগে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রতিবাদী ভূমিকা দেখে সাঈদীর তফসীর মাহফিল বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের তৎপরতা এখানে থেমে থাকেনি। ১৯৭৯ সনের শেষ দিকে একইভাবে পতেঙ্গা স্টিল। মিল বাজারে সাঈদীর তাফসির মাহফিল রুখে দিতে ইসলাম মিয়া টিকে সাহেব নিজের ট্রাক দিয়ে আমাদের নেতৃত্বে সোবহানিয়া আলিয়া ছাত্রদের সেখানে পাঠিয়েছেন। আমাদের জোরালাে প্রতিরোধের মুখে স্টিল মিল বাজার সাঈদীর মাহফিল ভণ্ডুল হয়ে যায়। এভাবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর তাফসির মাহফিলের নামে ভ্রান্ত মওদুদী আকিদা প্রচারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সোবহানিয়া আলিয়ার ছাত্ররা গর্জে উঠেছিল। পরবর্তীতে সোবহানিয়া আলিয়ার শিক্ষক মাওলানা এম এ মান্নান সর্বপ্রথম ‘দেলাওয়ার হােসেন সাঈদীর ভ্রান্ত তফসীরের স্বরূপ উন্মোচন’ গ্রন্থটি লিখে বাতিলের দুর্গে আঘাত হানেন। পতেঙ্গা স্টিল মিল বাজারের সাঈদীর মাহফিল প্রতিরােধ করতে পেরে আমরা ছাত্ররা খুবই উজ্জীবিত হলাম। আমি এর পরদিন দুপুরে মাদ্রাসা হােস্টেলে আমার ৯নং রুমে কয়েকজন সহপাঠি ছাত্রদের নিয়ে বৈঠকে বসি। আমরা দেখলাম, জামায়াত তার অঙ্গ সংগঠন ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে বিভিন্ন কলেজ- মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করে ছাত্রদের মধ্যে শিবিরের প্রভাব সৃষ্টি করছে। অথচ এদের বিপরীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা ছাত্রদের মধ্যে সুন্নি আকিদা প্রচারের কোনাে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেই। কোনাে বলিষ্ঠ ছাত্রসংগঠন না থাকায় এই শূন্যতা পূরণে কী করা যায় সিনিয়র ছাত্ররা বসে। ঘরােয়াভাবে আলােচনা করলাম আমার রুমে। এই বৈঠকে আমরা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সুন্নিদের অস্তিত্ব রক্ষায় অবশ্যই একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ব্যাপারে মতামত জানতে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী নূরুল ইসলাম হাশেমী (মাঃ জিঃ আঃ)’র সাথে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। সােনা মিয়া সওদাগরের ছেলে মুহাম্মদ ইব্রাহিমসহ আমরা কয়েকজন একই ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। ইব্রাহিম বড় লােকের ছেলে, টাকা পয়সা আছে, গাড়ি আছে, তাই তাকে সবাই সমীহ করে চলতে। পয়সাওয়ালাদের দাপট ও কদর আমাদের সময় ছিল । কাওয়ালী পরিবারের ছেলে হওয়ায় ছাত্রের কাছে ইব্রাহিমের আলাদা একটা প্রভাব ছিল। এ কারণে আমরা তাকে ভােলাবায়ে আহলে সুন্নাতের আহ্বায়ক বানিয়েছিলাম। আমার রুমে অনুষ্ঠিত ঘরােয়া বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে ইব্রাহিমের কার নিয়ে আমরা রওনা হলাম হাশেমী সাহেবের কাছে তাঁর জালালাবাদের বাড়িতে। ইব্রাহিমসহ আমাদের প্রতিনিধি দলে ছিলেন কাজী মুঈনুদ্দিন আশরাফী, আলিউল ইসলাম ও সউম আব্দুস সামাদ। আমরা হাশেমী সাহেব হুজুরকে ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মতামত নিতে এসেছি এ কথা বললাম। হাশেমী সাহেব হুজুর আমাদের কথা আগ্রহের সাথে শুনলেন। ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রবল আগ্রহ দেখে হুজুর জানালেন, ঐদিন রাতে তাঁর সাথে আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী সাহেবের একটি মাহফিল আছে। নঈমী সাহেবের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করে দু’তিন দিন পর তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। হাশেমী সাহেব হুজুরের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে অনুকূল সাড়া পেয়ে ইব্রাহিমের কারটি নিয়ে আমরা সােবহানিয়া মাদ্রাসায় ফিরে আসি। ছাত্রদের মধ্যে এ খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সবারই মধ্যে আগ্রহ- উদ্দীপনা ছিল লক্ষ্য করার মতাে। এদিকে আমাদের হুজুর ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠায় আমাদের উৎসাহ দিতে লাগলেন। আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী ঐ দিন রাতে নঈমী সাহেব হুজুরের সাথে মাহফিলে আমাদের প্রস্তাবটি নিয়ে আলাপ করলেন। তখন আল্লামা হাশেমী-নঈমী হুজুরের সাথে প্রায় মাহফিলে থাকতেন বর্তমানে; আহলা দরবার শরিফের পীর হযরত সৈয়দ সেহাব উদ্দিন খালেদ। তিনি খুব প্রভাবশালী ছিলেন। বাতিলদের ঠেকাতে এবং বিভিন্ন মাহফিলে আল্লামা- হাশেমী নঈমী হুজুরের নিরাপত্তা রক্ষায় সুন্নিদের ওয়াজ-মাহফিলে সেহাব উদ্দিন খালেদ সাহেব কে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করা হতাে। তিনি খুব সাহসী ও উদ্যমী ছিলেন। বাতিলদের হুমকি-আক্রোশের মােকাবেলায় মাঠ পর্যায়ে ওয়াজ- মাহফিল নিরাপদে- নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে আহলা দরবার শরিফের হযরত সৈয়দ সেহাব উদ্দিন খালেদ এবং তার অনুসারী- ভক্তরা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা রেখেছিলেন। আল্লামা হাশেমী- নঈমী সাহেবের সাথে আমাদের প্রস্তাব নিয়ে আলাপের সময় ঐ দিনের মাহফিলে সৈয়দ সেহাব উদ্দিন খালেদ যথারীতি ছিলেন। আল্লামা হাশেমী সাহেব হুজুর এ দু’জনের সাথে আলাপ করে আমাদের ডেকে একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালাে সমর্থন দিলেন এবং পরবর্তীতে এর জন্য যা কিছু করা দরকার পূর্ণ সহযোগিতা দিলেন তারা। ১৯৭৯ সনের শেষ দিকে ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৈঠক- প্রস্তাব- জল্পনা- কল্পনা ও নানামুখী উদ্যোগ চলছিল। এখানে আমি সবিস্তারে সব কিছু তুলে ধরছি না। মূল উদ্যোগের কথা বলছি। অবশেষে অনেক বৈঠক- মতবিনিময়ের পর চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিমে দেবপাহাড়ে আহলা দরবার শরিফের খানকায় প্রখ্যাত সুন্নি উলামায়ে কেরাম, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী ও কলেজ-মাদ্রাসার উদ্যমী। শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৯৮০ সনের ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা নামে আজকের এই জাতীয় ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুরু থেকেই বহু সুন্নি আলেম, পীর মাশায়েখের সাহায্য- সহযােগিতা ও সমর্থন আমরা যেমন পেয়েছি ঠিক বিপরীতে সুন্নি নামধারী বহু বড় বড় – আলেম- পীর মাশায়েখের ছাত্রসেনার সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করার করুণ ইতিহাস আমরা এখনাে ভুলিনি। তিন দশক আগে ছাত্রসেনা আত্মপ্রকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে পাশে ছিলেন ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী, অধ্যক্ষ আল্লামা সৈয়দ শামসুল হুদা, শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী, অধ্যক্ষ আল্লামা জাফর আহমদ সিদ্দিকী (রহঃ), আহলা দরবার শরিফের হযরত সৈয়দ সেহাব উদ্দিন খালেদ, এডভোকেট মোজাম্মেল হােসেন, এডভোকেট মহসিন সহ আরো অনেকে। বৃহত্তর পরিমন্ডলে সুন্নিয়ত প্রচারে নিবেদিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা সোবহানিয়া আলিয়ায় সুদৃঢ়ভাবে প্রচার- প্রসারে সুযোগ তৈরি করে দেন। তত্ত্বালীন অধ্যক্ষ পীরে তরিকত আল্লামা সৈয়দ শামসুল হুদা (রহ) এবং কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আর মাদ্রাসা কমিটির পক্ষ থেকে কোনো বাধা আমরা পাইনি। বরং ইসলাম মিয়া টিকে সাহেব ছাত্রসেনা কাজে নানাভাবে উৎসাহ এমনকি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
অন্যদিকে সুন্নিয়তের আরেক বড় প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত চট্টগ্রাম শহরের এক আলিয়া মাদ্রাসায় ছাত্রসেনায় অন্তর্ভুক্তির জন্য ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া দেখা যায় সত্য, কিন্তু পদে পদে ছাত্রসেনা গঠনমূলক শান্তিপূর্ণ সুন্নিয়ত প্রচারে আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত ও প্রবল বিরােধিতা করেছিলেন ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মহােদয় । তিনি ছাত্রসেনার আত্মপ্রকাশকে তার অধ্যক্ষ পদের জন্য অকারণে, হুমকি মনে করেই ছাত্রসেনার অগ্রযাত্রা পথে কাঁটা বিছিয়েছিলেন। এজন্য তিনি মাদ্রাসার ছাত্রদের শ্রদ্ধা শুধু হারাননি, শেষ পর্যন্ত ছাত্রসেনা পক্ষে সর্বস্তরের ছাত্র-শিক্ষকের জোয়ার দেখে ভীত হয়ে অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই অধ্যক্ষ মহোদয়ের বিষোদগার এক সময় চরমে উঠে। একদিন ফজরের নামাজের পর হঠাৎ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন- আজ থেকে ছাত্রসেনাকে ১ তালাক, ২ তালাক এবং ৩ তালাক দিলাম। একক ইচ্ছায় শীর্ষস্থানীয় এই সুন্নি মাদ্রাসায় ছাত্রসেনার যে কোনাে তৎপরতা নিষিদ্ধ করলেন তিনি। অধ্যক্ষ মহােদয়ের এ অনাকাক্ষিত ঘােষণায় ছাত্ররা ফুসে ওঠে। নীরব প্রতিবাদ হিসেবে ছাত্ররা অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে সালাম-কালাম বন্ধ করে দিল। সম্পূর্ণ একাকী অবস্থা এবং শােচনীয়ভাবে অপদস্ত জীবন, মেনে নিতে কষ্ট হওয়ায় অবশেষে তিনি তিন তালাক দেওয়া ছাত্রসেনাকে মাদ্রাসায় মেনে নিতে বাধ্য হলেন। কিন্তু তিনি আত্মসম্মান ফিরে পাবার জন্য ছাত্রসেনার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত নমনীয় হলেও মনে প্রাণে আমাদের শুভ কামনা কখনাে করেন নি। অনুরূপভাবে সুন্নি উলামা-পীরদের একটি অংশ শুরু থেকেই ছাত্রসেনার বিরুদ্ধে কূটনীতি ও নীরব-সরব জেহাদ চালিয়েছে। শুধুমাত্র ছাত্রসেনার মােকাবিলায় ১৯৮০ সনের পর বহু ছাত্র সংগঠন দাঁড় করানাে হয়েছে খ্যাত-অখ্যাত কিছু পীর-উলামার নেতৃত্বে বা ছত্রচ্ছায়ায়। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আল্লামা হাফেজ এম এ জলিল কিছুদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন ইসলামী ফ্রন্টের সাথে একাত্ম হওয়ার আগে ১৯৮০ সনের পর ছাত্রসেনার প্রসারে তিনি বাধাস্বরূপ ছিলেন। তিনি ছাত্রসেনা মোকাবিলায় প্রতিষ্ঠা করেন। আঞ্জুমানে তােলাবায়ে আহলে সুন্নাত। তিনি নিজেই এ ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হিসাবে পরিচয় দেন। আল্লামা সাইফুর রহমান নিজামী পৃষ্ঠপোষকতায় গঠন করা হয় জাতীয় ছুন্নী ছাত্রসেনা। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন সাইফুর রহমান নিজামী সাহেবের ছেলে হারুনুর রশিদ, সেক্রেটারী ছিলেন আজকের কথিত সুন্নি নেতা দাবিদার মাওলানা জয়নুল আবেদীন জুবাইর। হারুন- জুবায়েরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সুন্নী ছাত্রসেনা সুন্নাত ও সুন্নি ছাত্র- জনতার প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা শুধু মুখে বিরোধিতা করেন; কাগজে, লিফলেটে মাঠে ময়দানে ছাত্রসেনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী- হিংস্র ভূমিকা পালন করেছিল। এরা চট্টগ্রাম শহর ও গ্রামের অলি গলিতে দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরেছিল-যারা ইসলামী ছাত্রসেনা করে তারা কাফের। জয়নুল আবেদীন জুবাইর জাতীয় ছুন্নী ছাত্রসেনায় বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ওই সংগঠনেও উপগ্প-কোন্দল সৃষ্টির দায়ে সেক্রেটারি পদ থেকে তিনি বহিষ্কৃত হয়ে আশ্রয়হারা হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সনে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার সময় জুবাইর সাহেব আস্তাকুঁড়ে ছিলেন। ২ বছর পর ১৯৯২ সালের দিকে তিনি ছলে বলে কৌশলে বিভিন্ন দালাল চক্র সৃষ্টি করে তাদের সহযোগিতায় মুনাফিক খাসলত ত্যাগ করার কথা বলে সুন্নি সেজে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট আগন্তুক হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন সত্য, কিন্ত কপট ডিগবাজরা একজায়গায় বেশি দিন টিকে থাকতে পারেন না তা কর্মগুণে প্রমাণ করে ছাড়লেন মাওলানা জয়নুল আবেদীন জুবাইর। আরবিতে একটি কথা আছে, কুলু শাইয়িন ইয়ারজিউ ইলা আসলিহি- প্রত্যেকেই নিজ নিজ মূল পথে ধাবিত হয়। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা তথা সুন্নিয়তের ঘােরতর শত্রু জুবাইর সাহেব বার বার খােলস বদল করেও রেহাই পাচ্ছেন না। কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না- এই সত্যটি সুন্নি দাবিদার অনেকের কাছ থেকে সুন্নিরা বার বার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী- সমাজতন্ত্রের সাথে বিলীন হয়ে এই জুবাইর সাহেবরা আজ ইসলামী রাজনীতির ব্যানারে সুন্নিয়তের জন্য যতই মাঠ গরমের চেষ্টা আর মায়াকান্না করুক- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার সংগঠক এবং পরবর্তীতে সুন্নিয়তের মূলধারার একক রাজনৈতিক প্লাটফরম বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের নেতা-কর্মীরা তাদের ঠিকই চিনে রেখেছে। ছাত্রসেনার বিরুদ্ধে হাটহাজারীর একটি আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা তার ছেলেকে দিয়ে প্রায় দু’দশক আগে প্রতিষ্ঠিত করেন গাউসিয়া ছাত্র পরিষদ। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা সর্বাত্মক সাহায্য – সহযোগিতা ও সমর্থন দানের মাধ্যমে যখন সুন্নি আন্দোলন তীব্রতর করা জরুরি ছিল তখনই সুন্নিমনা ছাত্রদের বিভক্ত করে ওই গাউসিয়া ছাত্র পরিষদ চাঙ্গা করার চেষ্টা করেন শীর্ষস্থানীয় ও সুন্নি আলেম। যদিও হাটহাজারী গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি এই সংগঠনটি। ছাত্রদের সাড়া না পেয়ে অনেকটা আঁতুড় ঘরে অপমৃত্যুতে বিলীন হয়ে যায় গাউসিয়া ছাত্র পরিষদ। তেমনিভাবে একসময় সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র এস এম ফরিদ উদ্দিন অতি উৎসাহে ছাত্রসেনা মোকাবিলার চিন্তা থেকে ঘোষখালী গাউসিয়া আধ্যাত্মিক সংঘের নেপথ্যে লেখক সেনা’ নামে ভুঁইফোড় সংগঠন দাঁড় করানো হয়। নির্বিচারে অলেখদেরও এতে জায়গা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ওই কথিত লেখক সেনাও জোয়ার সৃষ্টি করতে না পেরে এক সময় প্রবল ভাটার টানে হারিয়ে যায়। ছাত্রসেনার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আল্লামা জাফর আহমদ সিদ্দিকী সাহেবের মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও এস,এম, ফরিদ সাহেব অনেক ঘুরপাক খেয়ে এখানে কপট দের সহযোগী হিসেবে ঠিক জায়গায় স্থান গেড়ে আছেন দেখে আমরা মোটেই বিস্মিত হচ্ছি না। মুজিব সেনা নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন ও এক সময় সুন্নিপন্থী দাবিদার কারা কারা প্রচ্ছন্ন-গােপন সহযােগিতায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সুন্নিয়তের ক্ষতির জন্য এবং ছাত্রসেনাকে কোণঠাসা করার কূটচালের অংশবিশেষ রূপে নানা পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ছুন্নী ছাত্রসেনা, আঞ্জুমানে তােলাবায়ে আহলে সুন্নাত, গাউসিয়া ছাত্র পরিষদ, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামী ছাত্র পরিষদ, লেখক সেনা, মুজিব সেনা ইত্যাদি ভুঁইফোড় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কুরআনে পাকের শাশ্বত সত্যায়ন অনুযায়ী ‘ওয়াজহাকাল বাতিল, ইন্নাল বাতিলা কানা যাহুকা’ ‘মিথ্যা কপটতা দূর হয়, দূর হবেই’- তা বাস্তবে দেখেছে এদেশের আম- জনতা। “জা আল হক্ব’ সত্য সমাগত-এই দ্বীনি প্রেরণা নিয়ে বাতিলদের পরাভূত করে বাধা ঠেলে ঠেলে জোর কদমে এগিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা। সুন্নিয়তের পক্ষে জাগরণের, গণজোয়ারের ঢেউ সৃষ্টি হয়েছে ছাত্রসেনার দ্বারা, ছাত্রসেনার প্রতিষ্ঠার কারণেই। এই সত্যটি বােধ হয় আজ আর অস্বীকার করা যাবে না।