বিশ্বকবি ও কবিদের গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর অমর পদ দিয়েই শুরু করছি।- এমন লজ্জাকর ও অপমানের প্রথা আর নাই। জীবনের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ দোকানদারি দিয়া আরম্ভ করা। যাহারা আজ বাদে কাল আমার আত্মীয়-শ্রেনীতে গণ্য হইবে তাহাদের সঙ্গে নির্লজ্জভাবে নির্মমভাবে দরদাম করিতে থাকা-এমন দু:সহ নীচতা যে সমাজে প্রবেশ করিয়াছে সে সমাজের কল্যাণ নাই,সে সমাজ নিশ্চয়ই নষ্ট হইতে আরম্ভ করিয়াছে।
ভূমিকা: বাংলা ১২৯৮ সালের ১৭ জৈষ্ঠ ’হিতবাদী’ পত্রিকায় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গল্প লিখেছিলেন ’দেনাপাওনা’ যৌতুক বা পন প্রথার নববধু নিরুপমার পিতৃপরিবারের নি:সম্বল হয়ে পড়া,শ^শুর বাড়িতে নিপীড়নে নিরুপমার মৃত্যু এবং বেশি যৌতুকের আশায় পাত্রের অবিলম্ভে বিবাহের ব্যাবস্থা করা-এইসব নিয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কালজয়ী কাহীনি গল্প ’দেনাপাওনা’। বিশ^ কবির কলম যুদ্ধের সাথে সহমত পোষণ করে আরো অনেক কবি সাহিত্যিক ও কলম যোদ্ধারা যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরলেও এখনও সমাজ থেকে দুর হয়নি যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধিটির। বরং এর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে এক বিশাল বিষবৃক্ষে রুপ ধারন করেছে। প্রতিদিনের চারপাশের জগত এ ধরনের সমস্যায় ভরা। টিভি ও খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে বিবাহিত তরুনীর আত্মহত্যা,অগ্নিদগ্ধ ও এসিড নিক্ষেপে নির্মম মৃত্যু হয়েছে। এটি শুধু মুসলিম সমাজেই নয়, হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান সমাজেও এ প্রথা বিষবৃক্ষের রুপ নিয়েছে।
যৌতুক প্রথার ইতিহাস: যৌতুক বা পণপ্রথার উদ্ভব সম্পর্কে ঋগে¦দের ১ম মন্ডল ১২৬শ সূত্রে ইঙ্গিত মিলে।পজ্রিবংশীয় যুবক কক্ষীবাণ পাঠ সমাপন করে স্বদেশে ফেরার সময় সিন্ধুদেশের অসূর নৃপতি ভবযবের পুত্র স্বনয় তার কণ্যার সঙ্গে কক্ষীবাণের বিবাহ সম্পর্কে করলে কক্ষীবাণ ১০০ স্বর্ণমূদ্রা ১০০ অশু এবং ১০০ বলীবর্দ যৌতুক বা পন নিয়ে বিবাহ করেন। মহাভারতের শল্যপর্বে তাপসীকণ্যা সুভ্রæর উপখ্যানে বরকে প্রলোভনের বস্তু প্রদানের উল্লেখ দেখা যায়। সমাজতাত্বিকেরা অনুমান করেন, বিজিত অনার্য রাজপরিবার ও উচ্চবর্ণীয় পরিবারগুলো বিজেতা আর্যদের সমকক্ষ হবার জন্য অথবা তাদের কণ্যা সম্প্রদান করে সমাজে উন্নত মর্যাদা পাবার জন্য আর্যপাত্রদের যৌতুক বা পণ প্রদান করতেন। অর্থাৎ চাহিদা ও যোগানের অর্ণনীতির নিয়মানুযায়ী পাত্রকে মূল্যবান মনে করতেন এবং একধরনের খাজনার মতই ছিলো তাদের যৌতুক।অথবা আর্য্য সমাজে প্রবেশের জন্যে তা ছিলো শুল্ক স্বরুপ। পুরুষ প্রধান সামন্ত সমাজে নারী মনুর অনুশাসনের অনুযায়ী বালিকা বয়স ছিলো পিতার,যৌবনে স্বামীর,বার্ধক্যে পূত্রের অধীন। নারীদের কোন ব্যক্তিত্বের মহিমা স্বীকারই করা হইতো না। ইউরোপেও মধ্যযুগে নারীর মর্যাদা তেমনভাবে স্বীকৃত হয়নি। লিওনার্দো-দ্যা- ভিঞ্চির মতো রেনেসাঁসের মহানায়কও লিখেছেন, কোন আগ্রাসন বা আক্রমণের হাত থেকে নারীর শারীরিক পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যে তার স্বমীর পরিবারে পাইক বরকন্দাজ রাখার প্রয়োজন। সে জন্য নববধুর পরিবারকে পাত্রের পরিবারের বরপণ দেয়া উচিত। এমনিভাবে যৌতুক বা পণপ্রথার উদ্ভব হয়েছে। ছোট ছোট রাজারা বড় বড় রাজাদের যে উপটোকন পাঠাতেন নিজেদের রাজ্য রক্ষার স্বার্থে, তাও যৌতুক প্রথারই অন্যরুপ। বর্তমানে এটি এতই সুপরিচিত এবং ব্যাপক বিস্তারিত হয়ে উঠছে যে, বিবাহ মানেই যৌতুক। আজকাল যৌতুক বিহীন বিবাহ হয় না এবং কল্পনারও বাইরে বললেই চলে ।
যৌতুক কি: ইসলামি বিধানমতে কনের পক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে-পরে শর্ত করে বা দাবি করে অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থ-সম্পদ ও টাকাপয়সা নেওয়া বা দেওয়াকে যৌতুক বলে। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ বলা হয়। বাংলা অভিধানমতে, যৌতুক হলো ‘বিবাহের পর বর বা কনেকে যে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত উপহার।’ (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান)। এই অর্থে যৌতুক ও মহরের মধ্যে বিভ্রাট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ইসলামে মহর হলো ফরজ ইবাদাত আর যৌতুক হলো বিলকুল হারাম ও সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তাই যৌতুক ও মহর এই উভয়ের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা জুরুরী।
ইসলামী বিধানমতে বরপক্ষের সামর্থ্যানুযায়ী ‘কনে পক্ষকে যে অর্থ বা সম্মাানি দেয়া হয় তা হলো মহর, মেয়েপক্ষ খুশি বা অখুশি হয়ে যা দেয় তার সবটুকই হলো নাযায়েজ যৌতুক।’ মেয়ের বাড়িতে শর্ত করে আপ্যায়ন গ্রহণ করাও হারাম যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুক চাওয়া ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা নিন্দনীয় ও জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধ। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনেও যৌতুক শাস্তিযোগ্য ও দন্ডনীয় অপরাধ। যৌতুকের শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হলে, বিয়ে কার্যকর হয়ে যাবে; কিন্তু যৌতুকের শর্ত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে অবৈধ শর্ত পালনীয় নয়, বরং বাধ্যতামূলকভাবেই তা বর্জনীয়।
উপহার বলতে আমরা নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ দানকেই উপহার বুঝি। এই উপহার যে কেউ যে কাউকে যেকোনো সময়ে যেকোনো অবস্থায় যেকোনো অবস্থানে যেকোনো অবস্থান থেকে দিতে পারেন। সুতরাং, বিয়ের সময় বা তার পরে স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে যেকোনো কিছু উপহার দিতে পারেন। তাই এটি উভয়পক্ষের একটি মঙ্গলজনক সহঅবস্থান ও সমঝোতার বিষয়।স্বামীর দেওয়া উপহার সাধারণত মহরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। কখনো যদি মূল্যবান গয়না ও অলংকার মহরের মধ্যে শামিল করা হয়, তখন বলা হয়ে থাকে ‘জেওর ও মহর’ এত টাকা এবং জেওর বা অলংকার বাবদ ওয়াসিল বা পরিশোধ এত টাকা বিষয়টি বেশিরভাগ সময় নিকাহনামায় উল্লেখ থাকে। কনের পরিবারের পক্ষ থেকে শর্ত ও দাবি ছাড়া বরকে কোনো উপহার দিতে বাধা নেই। তবে প্রথা বা অঘোষিত শর্তরূপে দিতে বাধ্য হলে তা পরিহারযোগ্য। বিবাহ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বর ও কনেকে উপহার দিতে পারেন। তবে এটি যেন প্রথারূপে না হয়। উল্লেখ্য যে মহর বাধ্যতামূলকভাবে প্রদেয় কিন্তু উপহার বাধ্যতামূলক নয় তবে অফেরতযোগ্য।
আমরা জানি সাধারনত বিয়ের সময় প্রদত্ত উপহারসামগ্রী বা অর্থের মালিক বর বা কনেই হবে। কিন্তু সমস্যা অনেকাংশেই হলো বর বা কনের পরিবার এখানে হিনমন্যতার পরিচয় দেন। যৌথ বা একক যে অবস্থানেই হোক না কেন বেশিরভাগ বরপক্ষ বিয়ের সামগ্রী দিয়ে সংসারে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে চায়,ব্যাবসা বানিজ্য করতে চায়,ঋণ পরিশোধ করতে চায়। বর বা কনে পক্ষ মুরুব্বীদের সামনে এই বিষয়ে কোন শব্দ করলে দ্বন্দ্ব,বিাবদ,বিভেদ ও মনমালিন্য দিয়ে সংসার যাত্রা শুরু হয় যেটি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। বরং পরিনতিতে পিতা পুত্র বা ভাই ভাই ঠাই ঠাই সুত্র দিয়ে সংসার আলাদা হইতে বাধ্য হয়। আসলে যে উপহার যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনিই সেই উপহারের মালিক। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য কেউ মালিকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এসব উপহার কাউকে দিতে পারবেন না এবং যথেচ্ছ ব্যবহারও করতে পারবেন না। স্ত্রী বা কনে প্রাপ্ত উপহার নিজে ব্যবহার করা ছাড়াও যাকে খুশি কারও অনুমতি ছাড়া দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা বরপক্ষের কারও কোনো এখতিয়ার থাকবে না; যদিও সেই উপহারসামগ্রী স্বয়ং স্বামী বা বরপক্ষই দিয়ে থাকে।
সমাজে আরেকটি ভয়ানক ব্যাধি হলো বর ও কনে পক্ষের পছন্দের পর বিয়ের আনুষ্ঠনিকতার সময় উভয়পক্ষের দর কষাকষি কেবল যৌতুক নিয়েই হয়না এটি দেনমোহর নিয়েও হয়।অধিকাংশ পরিবার এখন দেনমোহর ও যৌতুকের সাথে যোগ বিয়োগ মিলিয়ে বিয়ের সন্ধি করে থাকেন। যেটি খুবই দু:খজনক ঘটনা এবং পরিনামও ভালো হয় না। বরপক্ষের সামর্থ্য না থাকলেও কনে পক্ষে অধিক দেনমোহর প্রত্যাশা করে একইভাবে কনে পক্ষের সামর্থ্য না থাকলেও বরপক্ষ অধিক যৌতুকের প্রত্যাশা করে। বাস্তবে সামাজিকভাবে যেটি ঘটে সেটি হলো বাকিতে দেনমোহর তাই একটু বেশি ধরলে সমস্যা কোথায় এত ভয় কেন? উদাহরনস্বরুপ বলা যায় বরপক্ষ অবদমিত হবে ভেবে সাহস করে সামর্থ্যরে বাইরে থেকে বাকিতে দশ লক্ষ টাকা দেনমোহর প্রদানে রাজি হন। তারপর কনেপক্ষের খুশি হলে তারা পাচ থেকে আট লক্ষ টাকামূল্যের যৌতুক সামগ্রী প্রদান করেন। এখন সমস্য হলো কনে পক্ষ যে যৌতুক প্রদান করলেন তার কোন লিখিত দলিল নেই তবে বরপক্ষ যে দশ লক্ষ টাকার মোহর দিতে রাজি হলেন সেটি নিকাহনামায় দলিল হিসেবে উল্লেখ রইলো। এখন কোন কারনে বিবাহ ভেঙ্গে গেলে বা বিচ্ছেদ ঘটলে কনে পক্ষ যৌতুকের টাকা ফেরত চেয়ে লাভবান হইতে পারবে না। এমতঅবস্থায় তারা মোহনানার টাকার দাবি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন আাদালতে দাবি করতে পারবেন এবং বর পক্ষ সেটি দিতে বাধ্য থাকিবে। দেনমোহর ও যৌতুকের অর্থনীতির এই দ্বন্দ্ব গ্রাম শহর শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল পরিবারেই বিদ্যমান।
আমরা এই বিষয়ে আরো বিষদভাবে জানতে চাইলে-ধর্মীয়মতে দেনমোহর নারীর অধিকার, যা অবশ্যই স্ত্রীকে প্রদান করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা খুশিমনে স্ত্রীকে মোহর পরিশোধ কর।’ (সুরা আন নিসা : ৪)। তাই অন্যসব অধিকারের মতো স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবি করা স্ত্রীর অধিকার রয়েছে। দেনমোহর নির্ধারণ হয় স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের আলোচনাসাপেক্ষে। এর সর্বনিম্ন পরিমাণ ইসলামে নির্ধারিত আছে; সর্বোচ্চ পরিমাণের কোনো সীমা নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের খুশিমনে মোহর দিয়ে দাও, তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।’ (সুরা আন নিসা : ৪) মোহর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে স্বেচ্ছায় বেশি দেয়া নিন্দনীয় নয়। হজরত ফাতেমা (রা.)-এর মোহর ছিল একটি লৌহবর্ম। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, তার মোহর ছিল ৫০০ দিরহাম। বরকতপূর্ণ বিবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে উম্মাহাতুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতি বিয়ে; অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না।’ (মিশকাত শরিফ) সুতরাং মোহর হবে বরের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী। রাসূল (সা.) এক হাদিসে শরিয়তের মূলনীতিরূপে বলেছেন, ‘সাবধান, জুলুম করো না। মনে রেখো, কারও পক্ষে অন্যের সম্পদ তার আন্তরিক তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা হালাল হবে না। (মিশকাত/২৪৫)।
সমস্যা হলো বর্তমান সময়ে পূজিবাদী সমাজ ব্যাবস্থায় পেটিবুর্জোয়া চরিত্রের মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ব্যি পাচ্ছে। ফলস্বরুপ সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কে কার চেয়ে বেশি দেনমোহর দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে এবং কে কার চেয়ে বেশি যৌতুক দিবে- এ নিয়ে এক ধরনের ইগোকেন্দ্রীক প্রতিযোগিতায় নেমেছে উভয়পক্ষ। বরের সামর্থ্য বিবেচনা না করে বরের ওপর অযৌক্তিকভাবে ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। উভয় পক্ষের অভিভাবকরা দেনমোহর নির্ধারণকালে একবারও চিন্তা করেন না, বরের বর্তমান আয় অনুসারে মোটা অঙ্কের মোহর আদায়ের সাধ ও সাধ্যের সাথে তার মিল আছে কি না। এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে আলাপ করারও প্রয়োজন বোধ করেন না। অনেকেই মনে করেন, দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে দিতে হয় শুধু বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটলে। এটা অজ্ঞতা ও চরম ভুল ধারণা। বিয়েবিচ্ছেদ না হলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা ফরজ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের মজলিসে পাত্রীপক্ষের চাপে পাত্রপক্ষ দেনমোহরের ক্ষেত্রে সম্মত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যদি কোনো কারণে তালাক হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষকে দেনমোহরের পুরোটাই পরিশোধ করতে হয়। ব মুসলিম বিবাহ পারিবাইক আইন মতে দেনমোহর ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি তালাক যদি একতরফাভাবে স্ত্রীর পক্ষ থেকেও দেয়া হয়; তাহলেও দেনমোহর পরিশোধ করতে স্বামী বাধ্য।
সাম্প্রতিককালে অভিযোগ উঠেছে, একশ্রেণির নারী ও লোভী অবিভাবকগন বিয়ের দেনমোহরকে ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। বিয়ের কিছুদিন পর পরকীয়া কিংবা তুচ্ছ অজুহাতে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। এতে করে দেনমোহরের পুরো টাকা বরকে বহন করতে হয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালেও ইতঃপূর্বে রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে ব্যানারে লেখা ছিল- ‘মেয়ে যদি তালাক দেয়, ছেলেকে কেন দেনমোহর দিতে হবে।’ যত বিপদ ছেলেপক্ষের। অনেক সময় সমাজপতিদের চাপের মুখে ছেলেপক্ষ অতি উচ্চমূল্যে দেনমোহর নির্ধারণ করলেও তার পরিণতি ভোগ করতে হয় নতুন বউকে। কারণ এ দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করতে গিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে যে কলহের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবনের ওপরে পড়ে থাকে। মনে রাখা উচিত, নবীজি (সা.) তার স্ত্রী, কন্যাদের ক্ষেত্রে কত অল্প অঙ্কের মোহর নির্ধারণ করেছিলেন সেটি ভাবতেই অবাক লাগে। কাজেই কম মোহরানা নির্ধারণ কোনো সম্মানহানির বিষয় নয়। আবার মোটা অঙ্ক নির্ধারণও কোনো গর্বের বিষয় নয়।
যৌতুকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারন: যৌতুক একটি ঘৃন্যতম প্রথা হলেও আমাদের সমাজ এটি থেকে মুক্ত নয়। য়ৌতুক একটি অভিশাপ ও মরনফাঁদ হলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা কারনে সমাজের সকল স্তরের মানুষেরা এটি প্রদান ও গ্রহন করে থাকে। নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ছারা যৌতুক আদান প্রদানের প্রকৃত কোন সুনির্দিষ্ট কারন খুজে পাওয়া মুশকিল। এর পেছনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক যেসব কারন বিরাজমান সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতে পারি। যেমন- অর্থলিন্সা; পূজিবাদী অর্থব্যাবস্থায় ব্যক্তিকেন্দ্রীক সমাজের মানুষেরা লোভ লালসার উর্দ্ধে নয় বরং লোভের বশীভূত। লোভ মানুষ ও সমাজকে কুলষিত করে। এর মধ্যে অর্থলিন্সা খুবই প্রবল এবং ক্ষতিকর। সাধারনত বরপক্ষের নিকট হইতে বিশেষত তার পরিবার তথা পিতামাতা অর্থের লোভে কনেপক্ষের নিকট থেকে যৌতুক গ্রহন করে। বিয়ের পর কণ্যা স্বামীর বাড়িতে লালিত পালিত হয়। অথাৎ স্বামী তার ভরন পোষন করেন। বরের পিতা মনে করে তার ছেলেকে বড় করতে,লেখাপড়া শিখাতে অনেক টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত একজন মানুষকে ভরন পোষন করতে অর্থ ব্যায় হবে।এদিক থেকে বিচার বিবেচনা করে বরের পিতা কনেপক্ষের নিকট থেকে যৌতুক গ্রহণের মাধ্যমে তার ছেলের পেছনের খরচ পুষিয়ে নেয়।এটি যৌতুক প্রথার অন্যতম সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারন। আমরা আরো গভিরে গিয়ে বলতে পারি নারীর পরনির্ভরশীলতাও যৌতুকের অন্যতম কারন। যেমন- বিয়ের পূর্বে মেয়েরা পিত্রালয়ে পিতার ওপর,বিয়ের পর স্বমীর ওপর এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলেদের ওপর নির্ভরশীল। নারীদের হাজার বছরের এই প্রচলিত নির্ভরশীলতা যৌতুক প্রথার আরো একটি কারন। বিয়ের পর আজীবন স্বমী তাকে ভরন পোষন করবে,তাই স্বামী বা করের পিতা বিয়ের সময় কনের পিতার নিকট থেকে যৌতুক গ্রহন করেন। যৌতুকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারনের মথ্যে দারিদ্র্যতাও কম দায়ী নয়। দারিদ্র্য বা অথনৈতিক দুরবস্থার ফলে অনেক পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকে না।
সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করার জন্যে অনেকেই যৌতুক নিয়ে বিয়ে করে। যৌতুকের টাকা দিয়ে কেউ ব্যাবসা করে বা অন্য কোন উপার্জনের কাজে লাগায়। বর্তমানে যৌতুকের টাকায় বিদেশে যাওয়ার প্রচলন ও চাকরি দেয়া নেয়ার প্রচলন রেড়েছে। যৌতুকের অন্যতম একটি সামাজিক কারন হলো- দোষযুক্ত কণ্যা; কণ্যার যে কোন দোষ-ত্রুটি যৌতুকের অন্যতম কারন হয়। যেমন- কালো, বেশি কালো,কুশ্রী,বয়স বেশি,খোঁড়া, বিধবা,বোবা, এক চোখ অন্ধ, বা শরীরের কোন অঙ্গ হানিসহ বিশেষভাবে সক্ষম নারী। এছারাও ছেলেমেয়ের অবৈধ প্রেম,পরোকিয়া ও বিবাহ বিচ্ছেদসহ অন্যন্য সামাজিক দোষে দুষ্ট নারীদের বিয়ের ক্ষেত্রে বরের পিতাকে বেশি যৌতুক নিয়ে বেশ দরদাম করেই বিয়ে দিতে হয়। সমাজে নারীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। কণ্যা সন্তান মানেই সংসারের বোঝা ও আপদ মনে করা হয়। ছেলে সন্তান জন্মালে বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো আনন্দের বন্যাটা একটু হলেও বেশি দেখা যায়। আসলে সকল ধর্মেই নারীকে অবদমিত করা হয়েছে এবং পন্য সামগ্রীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। সমাজে নারীর প্রতি এই ধরনের অবমূল্যায়ন যৌতুক প্রথা বৃদ্ব্যির একটি গুরুত্বপুর্ণ কারন বলা যায়।
যৌতুক ও নারী নির্যাতন: ধনীদের জন্য যৌতুক একধরনের বিলাসিতা হলেও দরিদ্র্য অসহায় পিতার জন্য এটি একটি অভিশাপ। বর্তমান পূজিবাদী সমাজে যৌতুক প্রথা মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করেছে। এটা এমন একটি প্রথা যে নিত্যান্তই গরিব ও অসহায় পিতাকেও কণ্যার বিবাহে যৌতুক দিতে হচ্ছে। উপটোকনের কোন ব্যাতয় ঘটলে তখন একজন নারীকে প্রতি পদে পদে নির্যাতনের শীকার হইতে হয়। যৌতুকের অর্থ যোগাড় না হলে কণ্যার বিয়ে ভেঙ্গে যায়। এমনিভাবে যৌতুকের কারনে কত মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে তার হিসাব কি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে আছে? নাই! ফলে অসংখ্য পিতা মাতা ও কনে গলায় দড়ি দিয়ে বা বিষপানে আত্মহত্যা করার ঘটনা আমরা দেখতে পাই। এমনিভাবেই যৌতুক প্রথা আজ নারী নির্যাতনের অন্যতম কারন হয়ে উঠেছে।
পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যাবস্থায় বরপক্ষ মনে করে যৌতুক তাদের ন্যায্য পাওনা এবং স্বীকৃত পাওনার এক কানাকড়ি কম হলেও ঘটে যায় নানা অঘটন। আর এর সর্বনাশা পরিনতি বহন করতে হয় নিরপরাধ বধুকে। যৌতুক ব্যাধির যুপকাষ্ঠে কত সহজ সরল নিস্পাপ নারী যে নিগৃহিত,লাঞ্চিত,বঞ্চিত ,নানা ধরনের নির্যাতনসহ সামাজিক সহিংসতার শীকার হচ্ছে তার হিসাবও সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে নেই। যৌতুকের পরিমান সন্দেহজনক বা কথামতো না হলেই গৃহবধুকে নিষ্ঠুর নির্যাতন সহ্য করতে হয়। পরিত্যক্ত হইতে হয় স্বমীর সংসার থেকে। এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয় অবলা ছাবেলা নারীদেরকে। যে গৃহবধু যৌবনে স্বমীর সংসারে আদর স্নেহ,প্রেম-ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে এবং একটি সুখী সংসারের স্বপ্নে বিভোর হয়, সেই আবার য্যেতুকের কারনে লাঞ্চনা-গঞ্জনা ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তার সুখের স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়।
যৌতুকের প্রতিকারে আমাদের করনীয়: যৌতুক যে একটি সামাজিক ব্যাধি, একটি কুপ্রথা,একটি অসামাজিক নিষ্ঠুর প্রথা, এটি আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের সচেতন মহল অনুভব করতে পেরেছে এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু আইন প্রনয়ন করলেও সামাজিক সচেতনতা ও সুশাসনের অভাবে তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। নারীরা আজ আর অবলা ছাবেলা নয়। তারা এখন সাহস করে একটু ঘুরে দাড়ালেও বিশ্ব তাদের হাতের মুঠোও। নারীদের এই আত্মবিশ্বাসের জায়গায় সচেতন মহলকে আরো কাজ করতে হবে। আজ নারীরাও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সকল স্তরে সম্মান ও মর্যাদার পাত্র। শিক্ষা-সংস্কৃতি,জ্ঞানে,গুণে তারা অনেক দূর অগ্রসহ হয়েছে এবং আরো অগ্রসরের ওপর নির্ভর করছে তাদের টেকসই ক্ষমতায়ন। সুতরাং আধুনিক বিশ্বে আর যেন নারীরা নিগৃহিত না হয়,লাঞ্চিত বঞ্চিত না হয়,যাতে তারা স্বাধীনভাবে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহন করতে পারে,সেদিকে সুশীল ও নাগরিক সমাজকে লক্ষ রাখতেই হবে।
আবার যৌতুক প্রথা বিলোপ সাধনের জন্য সরকারকে আরো কঠোর আইন প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যাবস্থা গ্রহন করতে হবে। এ বিষয়ে সমাজের সকল স্তরে নাগরিকের সচেতনতা বাড়াতে হবে। নারীরা আজ সমাজের বোঝা নয় তারা সম্পদ। নারী ও পুরুষ সম্পদে সমান মালিকানার হকদার।একজন নারী পুরুষের চেয়ে তিন গুন বেশি পরিশ্রম করে এবং অর্থনৈতিক মজুরী ও সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি সরকার খসড়া নারী নীতিমালায় স্বীকার করলেও মৌলবাদ ও মোল্লাতন্ত্রদের দুষ্টচক্রের ভয়ে এটি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। নারী নীতিমালা বাস্তবায়নেও সচেতন মহলকে আরো সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীদের শিক্ষাব্যাবস্থায় আরো উন্নয়ন ও প্রসার ঘটাতে হবে। শিক্ষাদিক্ষায় উপযুক্ত হয়ে নানামুখীন কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের মাধ্যমে তারা স্বনির্ভর হলে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা এমনিতেই বিলোপ হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসহ সেচ্ছাসেবী সচেতন যুবনাগরিক প্লাটফর্মের মাধ্যমে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা আরো জোরদার করতে হবে। যৌতুক বিরোধী সাংস্কৃতিক চর্চা ও জাগরণ ঘটাতে হবে। আমাদের পিতাদের শপথ নিতে হবে যে কণ্যার বিয়েতে যৌতুক নয়, তাকে টাকা দিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলবো। বরকে শপথ করতে হবে যে আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে কোন প্রকার যৌতুক গ্রহন করবো না ও যৌতুক দিয়ে আমার বোনকে বিয়ে দিবো না। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি অর্থনৈতিক লালসা ও নিষ্ঠুর অভিশাপ। যৌতুকের কবল থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতেই হবে। সমগ্র বিশ্বে আজ নারীর অধিকার,নারীদের সুযোগ সুবিধা,তাদের শিক্ষা-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা নারীর শিক্ষা অধিকার ও ক্ষমতায়নের আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে চাই। তাই একটি নারীবান্ধব সামাজিক ন্যায্যতার বহুত্ববাদি সাংস্কৃতিক সমাজ বির্নিমানে জনগনের সচেতনতা ও সরকারে সুশাসনকে আরো শক্তিশালী রুপে দেখতে চাই।
তথ্যসূত্র: প্রফেসর আলাউদ্দিন আল আজাদ,ড. মনন অধিকারি,রুহুল আমিন বাবুল রচিত – উচ্চতর বাংলা ভাষারীতি,পৃষ্ঠা- ৪০২,০৩
তোষামদ ও রাজনীতির ভাষা,মুহাম্মদ আব্দুল হাই
গুগোল,উইকিপিডিয়া
দেনমোহর কখন যৌতুক হবে- আনোয়ারুল নিজামী,দৈনিক যুগান্তর,২৪-৭-২০২১