

অধিকাংশ মানুষ চায় সুখ-স্বাছন্দ্য ও বিলাসিতায় ভরা জীবন। একটু আরামে থাকার জন্য তাই চালিয়ে যায় অবিরত প্রচেষ্টা। এ কারণে সে কখনোবা মানুষের হক নষ্ট করছে। দুনিয়াবী সুখের জন্য আল্লাহকে ভুলে যাচ্ছে। অমান্য করছে খোদার দেওয়া নিয়ম। জড়িয়ে যাচ্ছে হারামের সাথে। সুদ, ঘুষ ও প্রতারণা সহ যাবতীয় অন্যায় তার জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে নিয়ে একবারও ভাবছে না। কে আমি? কী আমার পরিচয়? কতদিন এখানে আমার অস্তিত্ব? একশ্রেণির মানুষ এই দুনিয়াকে পাবার জন্য বেপরোয়া। যাচ্ছেতাই করছে। অন্যদিকে আর একশ্রেণির মানুষ রয়েছে। যাঁরা পরকালের জন্য ¯্রষ্টার রাজি-খুশিতে সবই করতে পারে। এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত আল্লাহর পথে কোরবান করে দিতে রাজি। প্রকৃতপক্ষে এঁরাই ইমানদার। এঁরাই মুমিন। তারাই মুসলমান। মুমিনতো সেই ব্যক্তি যে শত কষ্ট ও দুুঃখ-যাতনায় মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কথা স্মরণ রাখে। তাঁর মতে অঁটুট থাকে। এটাকে আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষা মনে করে। আর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর প্রিয় বান্দা হয়ে যায়। যার ইমান যত শক্ত হয় তার পরীক্ষাও তত কঠিন। এ কারণে নবী-রাসূলদের উপর আল্লাহর তরফ থেকে যে পরীক্ষাগুলো এসেছে তা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টদায়ক। তবুও তারা এই পরীক্ষায় ভেঙ্গে পড়েনি। বরং সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। তাঁর প্রিয় বান্দা হবার নজির স্থাপন করেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ পুত্রকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করেছেন। হজরত নূহ (আ.) আল্লাহর বারণ শিরোধার্য মনে করে আপন পুত্রকে চোখের সামনে প্লাবনে হারিয়ে যেতে দেখেছেন। হজরত জাকারিয়া (আ.) কে শুত্রæরা করাত দিয়ে দ্বিখÐিত করে দিয়েছে। তবুও তারা আল্লাহর উপর অখুশি হননি। কারণ তাদের দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ছিল। দ্বীনকে তারা বুঝতে পেরেছেন। দ্বীনের উপর অবিচল থেকেছেন। স্ত্রী-পুত্র পরিজন সবই তারা দ্বীনের জন্য কোরবান করতে প্রস্তুত ছিলেন। যে মুসলিম মিল্লাতের আদর্শ লালন করে নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করি, ইমানের সামান্যতম পরীক্ষা আসলেই শয়তানের ধোকায় পড়ে যাই। দুনিয়ার ঠুনকো স্বার্থে দ্বীনকে বিসর্জন দিয়ে থাকি। অথচ মুমিনের জীবন চলে গেলেও কখনো ইমান চলে যায় না। সে জীবনের চেয়ে ইমানকে বেশি ভালোবাসে। দ্বীনের অমীয় সুধা পান করতে পেরেছেন বলেই হজরত সাহাবায়ে আজমাইন (রা.) মৃত্যুসম যন্ত্রণা সহ্য করেও দ্বীনের উপর অবিচল ছিলেন। কেউবা দ্বীনের জন্য হিজরত করেছেন। আবার কেউবা ধনসম্পত্তি সবই আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন একটি সত্য দ্বীনের জীবন।
মানুষকে আল্লাহ এমন কষ্ট কখনোই দেন না, যা সে বইতে পারে না। তাইতো পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা সে কথাই বলেন,‘আল্লাহ কাউকে কখনো তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না…।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত- ২৮৬)। এ কারণে দুঃখ-কষ্ট আসলেই ভেঙ্গে পড়া যাবে না। বরং ইমান ও তরবিয়াত এর সাথে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি মানুষকে হাসান আবার মানুষকে কাঁদান। তিনিই মানুষকে মৃত্যু দেন, তিনিই জীবন দান করেন। ’ (সুরা নাজম, আয়াত- ৪৩)। দুঃখকষ্ট, হাসি-কান্না সব কিছুতেই মুমিনের কল্যাণ। যে মনে করে, সুখের মালিক যে আল্লাহ দুুঃখও তার কাছ থেকে আসে। কখনো তা পরীক্ষা আবার কখনো অর্জিত কর্মের প্রতিফল। যারা সবর ও ইখতিয়ার এর মাধ্যমে পরীক্ষার এই মুহূর্তগুলোয় ধৈর্যধারণ করে আর আল্লাহর হুকুমের উপরে খুশি থাকে তারাই সফলকাম। তাদের মুক্তি অনিবার্য। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো। কখনো ভয়ভীতি। কখনো ক্ষুধা অনাহার। আবার কখনোবা জন-মাল ও ফসলের ক্ষতি সাধন করে। যারা ধৈর্যের সাথে এর মোকাবেলা করে, তুমি সেইসব ধৈর্যশীলদের জান্নাদের সুসংবাদ দাও। যখন তাদের উপর কোনো বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবত আসে তখন যারা বলে, নিন্দেহে আমরা আল্লাহর জন্য। অবশ্যই একদিন আমাদেরকে তার কাছে ফিরে যেতে হবে। এরাই হচ্ছে সেইসব মানুষ, যাদের উপর রয়েছে তাদের মালিকের অবারিত রহমত ও অশেষ করুণা। আর এরাই সঠিক পথে রয়েছে।’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত : ১৫৫-৫৭)।
কষ্টে পড়লেই শয়তান মানুষকে ধোকায় ফেলতে চায়। ইমান হারানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। মনে এমন সব কথার উদয় ঘটায় যা ব্যক্তির ইমানকে দুর্বলতার দিয়ে নিয়ে যায়। এ কারণে দুর্বল ইমানের অধিকারী মানুষগুলো অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে। স্বার্থের কাছে বিকিয়ে যায়। কিন্তু একজন সাচ্চা মুমিন তার ইমানের উপর অবিচল থেকে শয়তানের মোকাবেলা করে। আর একান্ত মনে আল্লাহর সাহায্য চায়। বিপদকে যে ইমানের পরীক্ষা মনে করে সত্যের উপর অটুঁট থাকে। যা মুমিনের জীবনকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। যে সাফল্য পরম করুণাময় আল্লাহর হাতে। তিনিই এই পরীক্ষায় তাকে উত্তীর্ণ করে দ্বীনের সুষমায় জীবনকে অলংকৃত করেন। এ কারণে মহানবী (সা.) বলেছেন,‘আল্লাহ যার ভালো চান তাকেই তিনি দুঃখকষ্টে ফেলেন।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৫৬৪৫)। অন্য আরেক হাদিসে বলা হয়েছে,‘যদি কারো উপর কোনো কষ্ট আসে, এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তার কৃত গুনাহসমূহ ঝরিয়ে দেন; যেভাবে গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ে।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৫৬৮৪)।
কষ্টের সাথেই সুখ আছে। মানব জীবনে এ এক বৈচিত্রময় রহস্য। তাই কষ্টের সময় দিশেহারা না হয়ে ইমানের উপর অবিচল থাকতে হবে। আর বেশি বেশি আল্লাহকে ডাকতে হবে। বিপদে যেমন আল্লাহ কথা মনে রাখতে হয় তেমনি সুখের সময়ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হয়। এটাই মুমিনের পরম বৈশিষ্ট্য।
লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও ইসলামি গবেষক